(যখন স্কুলে পড়তাম, মাঝে মাঝেই রম্য রচনা লেখার ভূত চাপতো মাথায়। প্রথম আলোর ক্রোড় পত্রিকা “আলপিন” এর জন্য অনেক লেখা লিখেছিলাম সে সময়। অনিন্দ্য জাফরীর মহা ভক্ত ছিলাম আমি। ওনার ছিঃনেমা এখনো মিস করি খুব। চেষ্টা করতাম তার মত করে লিখতে। পারতাম না। যাওবা লিখেছি সেটাও কখনো পাঠানো হয়নি। সামনে ঈদুল আযহা। তাই ভাবলাম “ভালবাসি তাই ভালবেসে যাই” এ একটা লেখা দেই। যদিও এই লেখাটা আমার স্কুলের সময়ের লেখা, কিন্তু কোরবানীর ঈদ নিয়ে। তাই লেখাটা দু একটা জায়গা মেরামত করে দিয়ে দিলাম আপনাদের কাছে। রম্য রচনা। এখানে ভালবাসা সম্পর্কিত কিছু নেই বলে দুঃখিত। সবাইকে ঈদ মোবারাক। আর অনেক অনেক ভালবাসা। :-)
-লেখক )
আর দু’দিন বাদেই কুরবানীর ঈদ। গরূ-ছাগল কেনার ধূম পড়ে গেছে চারদিকে। তবে ঈদের বেশি আগে আগে কেউ গরূ ছাগল কেনার পক্ষপাতি নয়। কারণ বাসা বাড়িতে গরু কিনে আনলে গরু দেখা শোনা কে করবে? তাই একেবারে ঈদের আগ মুহূর্তে এসে সবাই পাগল হয়ে উঠেছে। গরু হোক, ছাগল হোক একটা কিছু তারা কিনেই ছাড়বেন। তার ওপর শুরু হয়েছে বিভিন্ন রকম প্রতিযোগিতা। কে কত কম দামে বেশি বড় গরু কিনছে। কিংবা কে কত বেশি দামে গরু কিনছে তার প্রতিযোগিতা। প্রথম প্রতিযোগিতাটা করছে মধ্যবিত্ত ফ্যামেলির লোকেরা। আর দ্বিতীয় প্রতিযোগিতাটা হচ্ছে শহরের উদিয়মান বিত্তবানদের মধ্যে। তারা কে কত বেশি দামে গরু-ছাগল কিনতে পারছেন তার প্রতিযোগিতা। গ্রামের মাতব্বর মোতালেব আলী সাহেব মাত্র একমাস হয়েছে ঢাকা শহরে কেনা বিরাট ফ্ল্যাট বাড়িতে এসে উঠেছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তার বিরাট যৌথ পরিবারটিকে। তার দুই ছেলে, তাদের বৌ, দশ বারোটা বাচ্চা কাচ্চা, মেয়ে সহ ঘর জামাই কোরবান আলী এবং তাদের ছয়টা দেশি মুরগী এবং পাঁচটা ছাগল। মোতালেব সাহেবের স্ত্রী তার সাথে রাগারাগি করে গ্রামের বাড়িতেই থেকে গেছেন। স্বামীর সঙ্গে আসেননি। মোতালেব সাহেবও মেজাজ দেখিয়ে চলে এসেছেন শহরে। উদ্দেশ্য শহরের অচেনা পরিবেশে থেকে কিছু শিখবেন। সারা জীবন তো গ্রামে ক্ষেত খামার করেই কাটালেন কয়েক পুরুষ ধরে। এখন একটু আধুনিক হওয়া দরকার। বহুদিনের শখ একটা এসি গাড়ি থাকবে তার, সেটায় করে ঘুরে বেড়াবেন। তবে এসি গাড়ি এখন-ই কেনেননি, আপাতত একটা ড্রাইভার সহ বিক্সা কিনেছেন। গাড়ি কদিন পর কিনবেন, ঈদের ঝামেলাটা যাক।
কদিন ধরেই মোতালেব সাহেব বড় অশান্তিতে আছেন। কারণটা হল তাদের পাশের ফ্ল্যাটের আসগর সাহেব। ঐ ভদ্রলোকের ইটের ভাটি আছে। ইটের ব্যবসা করে আসগর সাহেব আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ না, একেবারে কাঁঠাল গাছ হয়েছে। বহুদিন দেশের বাহিরেও ছিলেন। তাই ভাল করে বাংলা বলতে পারেন না। এসি গাড়িতে করে প্রতিদিন মোতালেব আলীকে দেখিয়ে হুশ করে তাঁর বিক্সার সামনে দিয়ে সাভারের অফিসে চলে যান। যাবার সময় মোতালেব আলীকে ইচ্ছে করে ভেংচি কেটে বলেন, “এক্সকিউজ মি, ওয়ান্ট লিফট?”
মোতালেব আলী বেচারা অশিক্ষিত মূর্খ মানুষ। ইংরেজী কথাটার মর্ম বুঝতে পারেন না। অবাক হয়ে বলেন, “এ্যাঁ? কি বলেন?”
গাড়ির জানালা দিয়ে আসগর সাহেব মাথা বের করে বিদেশি ব্রান্ডের সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলেন, “না মানে বলছিলাম- আপনার কি লিফট প্রয়োজন?”
মাথা চুলকে মোতালেব আলী একটু চিন্তা করলেন। তার বড় ছেলে একবার বসুন্ধরা সিটিতে তাকে নিয়ে গিয়ে একটা বিচিত্র স্টিলের বাক্স দেখিয়ে বলেছিল, “আব্বাজান, এইডারে কয় লিফট। এইডা দিয়া মানুষরে ওপরে পাঠায় দেওয়া হয়।”
ভদ্রলোক লিফট নামক বস্তুটাকে তখন থেকেই ভয় পান। ঐ চিজ দিয়ে মানুষকে একেবারে উপরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মানে পরপারে। ভয়ে ভয়ে ভাবলেন আসগর নামের ঐ লোকটা হঠাৎ তাকে ওপরে পাঠানোর তালে পড়ল কেন? তার সহায় সম্পত্তি মেরে দেয়ার ফন্দিতে নেই তো! চিমশানো সাহি মেরে মোতালেব সাহেব কথার পাশ কাটালেন, “বাই, আমার লিফটের কুনো প্রয়োজন নাইক্কা। আমি আরো বহুদিন বাঁচিতে চাই। এই বিক্সা ভাই- চলেন চলেন।” কোনোমতে কেটে পড়েন।
কিন্তু তারপরও আসগর সাহেবের হাত থেকে তার নিস্তার নেই। ঐ ভদ্রোলোক সুযোগ পেলেই আলাপ জমাতে আসেন, কথার তালে তালে বলেন, “এই নিন ভাই, জার্মানি থেকে আমার শালার পাঠানো চুরুট, মানে সিগারেট। খেলেই আপনার আত্মা শান্তি পাবে। মোতালেব সাহেব যাতে বুঝতে পারেন তাই বাংলায় বলার চেষ্টা করলেন আসগর সাহেব, কিন্তু ইংরেজী বলে বলে মুখ দিয়ে এখন আর বাংলা বেরুতেই চায় না। আর বের হলেও কথাটার মানে দাঁড়ায় উল্টো কিছু। যেমন এখন তার ‘আত্মা শান্তি পাবে’।
এটা শুনে মোতালেব সাহেব ভেবে বসলেন তাকে বুঝি সিগারেট খাইয়ে মারার তালে আছেন আসগর সাহেব! তাই বাঁচার জন্য চিঁ চিঁ গলায় বলে উঠলেন, “ইয়ে না মাইনে, কইতেছিলাম কি……. আমার আবার ইম্পোর্টেরেড জিনিস শইলে সইহ্য হয় না। আমার দেশি হুক্কাডাই ভালা।”
ইদানীং বিদেশী চ্যানেল টিভিতে দেখে দেখে ইম্পোর্টেড শব্দটা শিখেছেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে মিন মিনে গলায় বলেন, “মা জোলেখা! কইগো মা জোলেখা? আমার দেশি হুক্কাডা একবার দিয়া যাওতো মা।” জোলেখা তার মেয়ে। সে হুক্কাতে আগুণ দিয়ে নিয়ে আসে বাবার জন্য। তখন মোতালেব সাহেব আসগর সাহেবকে দেখিয়ে দেখিয়ে হুক্কা টানেন।
ইদানীং তিনি পার্কেও হাটতে যান সকাল বেলা। ভেবেছিলেন প্রাত রাশটা অন্তত আসগর সাহেব ছাড়া শান্তিতে হবে। হয়নি। প্রথম দিনে গিয়ে একেবারে আসগর সাহেবের সামনেই পড়েছেন। ভদ্রলোক হাফ প্যান্ট, বোগল বের করা গেঞ্জি আর সাদা বেস বল ক্যাপ পরে ব্যায়াম করছেন পার্কে। মোতালেব সাহেবকে দেখেই কথা বলতে এগিয়ে এলেন, “এই যে মোতালেব ভাই, কি আশ্চর্য! আপনার মত মানুষও পার্কে আসে তাহলে! মাই গুডনেস! তাহলে একটা সিগারেট হয়ে যাক?” বলে হাফ প্যান্টের পকেট থেকে একটা চুরুটের নতুন বক্স বের করলেন। একটা মোটা চুরুট মোতালেব সাহেবকে এগিয়ে দিতেই আৎকে উঠলেন মোতালেব সাহেব। পাছে তাকে এই বিদেশী কলা খাইয়ে ওপরে পাঠিয়ে দেয়, তাড়াতাড়ি লুঙ্গির গোছা খুলে এক প্যাকেট আবুল বিড়ি বের করলেন। মনের সুখে আগুণ ধরিয়ে ফুঁক দিতে দিতে বললেন, “ ভাইজান দিশি জিনিসের স্বাদই আলাদা। ডাইফারেন্ট!”
আসগর সাহেব কাঁধ ঝাকিয়ে ‘কি আর করা’ ভাব করে নিজেই চুরুট ধরালেন। ধোঁইয়া ছাড়তে ছাড়তে মোতালেব সাহেবের লুঙ্গির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “ভাই সাহেব, পার্কে লুঙ্গি পরে আসেন কেন? ট্রাউজার পরে এলেই তো পারেন।”
আবুল বিড়িতে গ্রাম্য কায়দায় ফুঁক দিতে দিতে মোতালেব সাহেব ভাবলেন মনে মনে, “ট্রাউজার! এইডা আবার কোন চিজ?” মুখে বললেন, “ভাই আপনেও তো আধখান প্যান্ট পইরা আইছেন!”
“এটাকে জগিং স্যুট বলে, আপনার ভাষায় হাফ প্যান্ট।” শুধরে দিলেন আসগর সাহেব।
“ও! বাইল্য কালে আমিও অনেক পরছি।”
“হাফ প্যান্ট?”
“জেনা। লিঙ্গি মালকোচা দিয়া হাফ প্যান্টের লাহান। খেলবার সময়।”
“কি খেলা? জগিং জাতীয়?”
“জেনা, কাবাডি আর কুস্তি। এক কালে আমি দশ গেরামের কুস্তি আর কাবাডি চ্যাম্পিয়ান আছিলাম।” গর্বের সাথে বললেন মোতালেব সাহেব।
শুনে ঢোক গিললেন আসগর সাহেব। টিংটিঙয়ে ইঁদুর মুখো মোতালেব সাহেবের দিকে তাকালেন, “এই শরীরে আপনি……”
“ভাইজান, অহন তো শুকায়া গেছি। আগে আমার শইল পাহাড়ের লাহান আছিল! হাম আর আমাশয় কাবু করি ফালাইছে।”
“ভেরি গুড, ভেরি ভেরি গুড।” আসগর সাহেব শুকনো হাসি হেসে চলে গেলেন অন্য দিকে। মোতালেব সাহেব সামান্য চিন্তিত মুখে ভাবলেন অজগরটা তাকে ভেড়া বলে চলে গেল নাকি?
আজকে মোতালেব সাহেবের মেজাজ ভয়াবহ গরম, বাসায় ঢুকেই চিৎকার দিয়ে পুরো ফ্যামেলিকে ডাকলেন, “আব্দুল, মকবুল, বড় বৌ, ছোডো বৌ, জোলেখা, কোরবান আলী, নাতি পুতিরা কই গেলা তোমরা? অখ্যনি আসো!”
সবাই ভয় পেয়ে দৌড়ে এল।
“আব্বাজান! কি হইছে?” ছেলেরা ভয়ার্ত মুখে ড্রইং রুমে ঢুকে দেখল মোতালেব সাহেব ফ্যান ফুল স্পিডে চালিয়ে দিয়ে সোফার ওপর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছেন! জোলেখা ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি হাত পাখা এনে বাবার মুখে বাতাস করতে লাগল। থাবা মেরে হাত পাখা সরিয়ে দিলেন মোতালেব সাহেব, খেঁকিয়ে উঠলেন, “ঐ! উপরে এত্ত বড় পাংখা লাগাইছে দেখসনাই? তোর হাত পাখার বাতাস খাওনের শখ নাই আমার। দূর হ!”
আব্দুল বলল, “আব্বাজান, কি হইছে? কেউ কিছু কইছে? আমারে বলেন, গলাটা নামায় দিয়াসি।”
মকবুল পাঞ্জাবীর হাতা গোটাতে গোটাতে বলল, “কোন শালা আমার আব্বাজানের গায়ে হাত তুলছে? ওরে আমি দুনিয়া থেকইক্কা সরায়া দেমু।”
ঘর জামাই কোরবান আলী বলল, “কে আমার আব্বাজানরে অফমান কইচ্ছে? নামটা বলেন খালি….. ওরে আমি ডিস্টরয় করি ফালামু!”
এতক্ষণে মোতালেব আলী কথা বলে উঠলেন, “খামোস! দেশি ডগ বিলাতি মাত মাতবানা। ………. বৌ মা, আমার জন্য ঠান্ডার বাক্স থেইকা কয়েক কেজি বরফের টুকরা আইনা দেও। মাথায় চাপা দিমু।”
বউরা দৌড়া দৌড়ি করে ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে এল মাথায় চাপা দিল শ্বশুড় সাহেবের। মিনিট দশেকের মাথায় মোতালেব সাহেবের তাপমাত্রা কমল। দম ফেলে বললেন, “জানস তোরা, পাশের বাড়ির অজগর সাহেব কোরবানীর লাইগা বাজারের সব থেইক্কা বড় ছাগলটা কিননা আনছে! আমারে আবার ডাইক্কা দেখায় শালায়!”
“আইচ্ছা!” হুংকার দিল কোরবান আলী, “আমার আব্বাজানের ওফর টেক্কা! আমি অহনি হাটে যাইতেছি আব্বাজান, হাটের সব থেইক্কা বড় কাউটা আমি কিন্না আনুম!” লিঙ্গির গোছা মেরে বাজারের বস্তা তুলে নিল কোরবান আলী। এখনই রওনা দেবে।
“থামো কোরবান আলী! কাউয়া কিন্না তুমি কি করবা?” মোতালেব আলী অবাক গলায় বলে উঠলেন।
“কাউয়া না আব্বা, কাউ- গরু।” অনুবাদ করে শণাল কোরবান।
হাত নেড়ে বললেন, “খামোস! ঐ শালা অজগর ছাগল কিনছে! গরু কিন্না নিজেরে মিসকিন প্রমাণ করবার চাও নাকি। কিনলে ছাগলই কিনতে হইবো! শোনো পোলারা, জামাই বাবারে লইয়্যা অক্ষনি হাটে যাও। হাটের সব থেইক্কা দামি ছাগলটা আমার চাই। ঐ অজগরটারে দেখায়া দেবো কত গমে কত আটা।”
ছেলেরাও লুঙ্গি মালকোচা মেরে হুংকার দিল, “আব্বাজান, ওয়াদা কইচ্ছি, হাটের সব থেইক্কা আলিসান ছাগলটা আপনের লাইগ্যা লইয়া আমু। ঐ, চল সবাই!”
কোরবান আলী, আব্দুল, মকবুল ঝড়ের বেগে তিনটা বাজারের ব্যাগ হাতে হাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। বড় ছাগল আজ তারা কিনেই ছাড়বে।
ওরা চলে যাওয়ার পর মোতালেব আলী একটু অবাক গলায় বলে উঠলেন, “ছাগল কিনতে যাইতেছে বুঝলাম। মাগার তিনটা বাজারের ব্যাগ নিয়া গেল ক্যান?”
জোলেখা হাত পাখা দিয়ে মোতালেব সাহেবের মাথায় বাতাস করতে করতে সরল মুখে বলল, “মনে হয় বেশি বড় ছাগল হইলে তিন জনে ভাগা ভাগি করে আনবে।”
মেয়ের দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকালেন, “তারা কি ছাগল কুরবানী দিয়া আনবে?”
“এইটা তো জানি না আব্বা।” জোলেখা চিন্তিত মুখে বলল।
“পাংখা সরা! উপরে ইলেক্টিরিক পাংখা ঘুরতাছে দেখস না!” ধমকে উঠলেন আবার। তাড়াতাড়ি পাখাটা রেখে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল জোলেখা। আব্বার আশে পাশে থাকা বিপজ্জনক।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। মোতালেব সাহেবের ছেলেরা এখনো ফেরেনি। হাটে গেছে অনেক্ষণ হল, এখনো আসেনি। উদ্বিগ্ন মুখে পেছনে হাত রেখে পায়চারি করছেন। বিড়বিড় করছেন আপন মনে। জোলেখা এসে বলল, “আব্বাজান! আপনের জামাই তো অহনও আইলোনা!”
“চিন্তা করতেছো ক্যা? আমার দুইডা পোলাও তো গেছে। ওদের লাইগ্যা চিন্তা না কইরা ঐ বলদাটার জন্য চিন্তা করস ক্যান?”
ক্ষুন্ন গলায় জোলেখা বলল, “আব্বাজান! আপনে শুধু শুধু ওনারে দোষ দেন। গাল মন্দ করেন। উনিতো ভালো মানুষ।”
বিরক্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন মোতালেব সাহেব। মায়ের মত মেয়েটাও হয়েছে। কথার পিঠে কথা কয়! অন্য সময় হলে ধমক দিতেন, কিন্তু এখন কি ভেবে ধমক দিলেন না। গিয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে ঢক ঢক করে খেলেন। এমন সময় ক্লিং বেল বেজে উঠল। সবার আগে দৌড়ে গেলেন মোতালেব সাহেব। দরজা খুললেন। অবাক হয়ে দেখলেন তার জামাই কোরবান আলি একাই এসেছে। খালি হাতে। বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কি ব্যাপার জামাই? ছাগল কই? আমার পুলা দুইডা কই?”
হে হে করে দাঁত বের করে হাসল কোরবান আলী, “আব্বা, আফনে অক্ষণও ছাগল দেখেন নাই! এইডা কি?” বলে পেছনে দেখালো। মোতালেব সাহেব অবাক হয়ে দেখল কোরবান আলীর পেছনে চারটা খয়েরী রঙএর উঁচু উঁচু পা দেখা যাচ্ছে, “বডি কই ছাগলডার?”
“ওপরে!” আঙ্গুল তুলে দেখতে বলল কোরবান। তিনি মাথা তুলে তাকাতেই হা হয়ে গেলেন চার পায়ের ওপর বিশাল একটা খয়েরী দেহ দেখে। মাথাটা দেখাই যাচ্ছে না। অনেক লম্বা গলা।
“ইয়া মা-বু-দ! এইডা কি?”
গর্বের সাথে কোরবান জানালো, “আব্বাজান! আপনের কথা মত হাটের সব থেইক্যা বড় ছাগলডা লয়া আসলাম, গলা লম্বা ইম্পোর্টেরেড ছাগল। সৌদি আরব দেশ থেইক্যা পাসপোর্ট ভিসা দিয়া আনা হইছে!”
বিশাল গলা লম্বা ছাগলটা দেখতে ইতিমধ্যে আশেপাশের বাড়ির লোকেরাও চলে এসেছে। কোরবান আলীর কাঁধ চাপড়ে বললেন মোতালেব সাহেব, “নাহ জামাই, সত্যিই তুমি বড় কাজের। এত বড় ছাগল আমি ক্যা, আমার চৌদ্দ গুষ্ঠীও দেখে নাইক্কা……. বাই দা রাস্তা, আমার পুলা দুইডা কই?”
“বন্ধক রাইখা আইছি।” কোরবান আলী হাসি হাসি গলায় গলায় বলল।
মাছের মত খাবি খেতে খেতে মোতালেব সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “খাইছে! মানে?”
“ছাগলডার দাম মেলা। আট লক্ষ পঁচাত্তর হাজার ট্যাহা। অত ট্যাহা তো নাই আমাগো। তাই ভাইজান গো বন্ধক রাখি আইছি। লগে বিক্রেতা ভাইগো লইয়া আইছি, পুলিশ আসছে।”
“পু-পু-পুলিশ!”
“হ!”
“পুলিশ ক্যান?”
“ফ্ল্যাটের দখল নিবো ওরা।” কোরবান এক গাল হেসে জানাল।
“খাইছেরে! ক্যান!” বুক খাঁমচে ধরলেন নিজের।
“ভাইজান গোরে ছুডাইতে হইবো না? তাই ফ্ল্যাট বেঁচি দিছি।”
মরা চোখে মোতালেব সাহেব কোরবান আলীর পেছনে তাকালেন। সৌদির পোশাক পরিহিত কয়েকজন লোক, পুলিশ এবং ক্যামেরা হাতে কজন সাংবাদিক এসেছে। “সাংবাদিক ক্যা?” কোনো মতে চিঁ চিঁ করে বললেন।
কোরবান আলী দারাজ হাসি হেসে বলল, “আব্বা, কোরবানীর সব থেইক্কা দামী ছাগলডা আমরা কিনছিতো, তাই এই ভাইয়েরা আমাগো সাক্ষাতকার লইতে ‘দি কাশেম টিভি’ থেইক্কা আইছে। পেছনে আরো আছে।”
“কারা?”
“শেফালী টিভি, আবুল টিভিও সাক্ষাতকার লইবো। সঙ্গে ‘দৈনিক মাগুর মাছ’ তো আছেই। তয় আগে ফ্ল্যাট ছাড়তে হইবো। দখল নিয়া কথা তো, লেনদেনের কাম আগেই সারা ভালো।” বিজ্ঞের মত বলল কোরবান আলী।
বুক চেপে ধরে কোঁ কোঁ করতে করতে মোতালেব সাহেব মেয়েকে ডাকলেন, “জোলেখা মা? রান্না ঘর থেইক্কা রাম-দা’টা লয়া আসো তো!”
“আব্বা, কুরবানী তো কাইল, আইজ ছাগল কোরবানী করবেন নাকি?” কোরবান অবাক গলা বলল।
“জেনা! আপনারে কোরবানী করবো। এই হাটের সব চাইতে বড় ছাগলডারে!” হুংকার দিলেন মোতালেব সাহেব।
লেখকের নামঃ মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাব